প্রাথমিক তথ্য- সবজি চাষের জন্য আলো বাতাস চলাচলের সুবিধাযুক্ত, সেচ নিকাশের ব্যবস্থাসহ উঁচু, জমি নির্বাচন করা উচিত। সবজির মধ্যে অধিকাংশই উর্বর বেলে দোঁআশ হতে দোঁআশ মাটি বেশি পছন্দ করে। জলাবদ্ধতা প্রায় সবজি সহ্য করতে পারে না। আবার একনাগাড়ে দীর্ঘ খরা হলেও উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সবজি চাষের জমি যেন ছায়াযুক্ত না হয় সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। শুধু মৌসুমি সবজি চাষ করতে হলে মাঝারি নিচু বা নিচু জমিও নির্বাচন করা যায়।
প্রয়োজনীয় উপকরণ
১. উঁচু (বন্যায় বা বৃষ্টিতে পানি উঠে বা জমে না) জমি।
২. মাটির বুনট সম্পর্কিত তথ্য বা মাঠভিত্তিক মৃত্তিকা ম্যাপ ।
৩. কী ধরনের সবজি চাষ করা হবে সে পরিকল্পনা।
কাজের ধাপ- সবজির ধরন অনুযায়ী জমি ও স্থান নির্বাচন করতে হবে। যেমন- আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, কুমড়া জাতীয় ইত্যাদির জন্য উঁচু বা মাঝারি উঁচু এবং বিনা চাষে আলু রোপণ ও পানি কচু ইত্যাদির জন্য নিচু জমি নির্বাচন করা যাবে।
১. বেলে দোঁআশ হতে দোঁআশ মাটির জমিতে আলু, মূলা ভালো হয়। এঁটেল দোঁআশ মাটিতে কপিজাতীয় সবজি ভালো হয়। তাই সেভাবে ফসল অনুযায়ী জমি নির্বাচন করতে হবে।
২. বাড়ীর বা গাছের ছায়া পড়েনা এমন আলোবাতাসমুক্ত জমিতে প্রায় সব ধরনের সবজিরই ফলন ভালো হয়।
৩. বৃষ্টির পানি যাতে না জমতে পারে বা সেচের পানি তাড়াতাড়ি সরে যেতে পারে এমন স্থান সবজির জন্য । উত্তম। তাই এ ধরনের সুবিধা দেখে সবজির জমি নির্বাচন করতে হবে।
৪. সবজিভিত্তিক মাটি, জমির অবস্থান ও অন্যান্য সুবিধা বিবেচনা করে সবজির জমি ও স্থান নির্বাচনের জন্য খাতায় সকল উপাদানগুলো লিখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
প্রাথমিক তথ্য-সবজি সাধারণত চারা তৈরি করে চাষ করা হয়। অনেক সবজির বীজ সরাসরি বপন বা রোপণ করা হয়। ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, মরিচ, টমেটোর চারা তৈরি করা হয়। গাজর, মূলা, ধনিয়া, সিলারির বীজ সরাসরি জমিতে বপন করা হয় (লাইনে/ ছিটিয়ে)। চালকুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, ঝিঙা, চিচিংগা, শশা, কাঁকরোল, শিম মাদা করে বীজ রোপণ করা হয়। তবে চারা তৈরি করে, বীজ বপন/রোপণ করে, মাদায় বা লাইনে বীজ রোপণ করে সবজি চাষে সবক্ষেত্রেই বেড তৈরি করা হয়।
প্রয়োজনীয় উপকরণ
১. এক খন্ড জমি যা কর্ষণ করে প্রস্তুত করা।
২. বিভিন্ন সবজি রোপণের/বপনের জন্য বেডের মাপ সম্পর্কিত তালিকা/চার্ট
৩. মাপার টেপ/ফিতা।
৪. বাঁশের খুটি প্রয়োজনীয় সংখ্যক।
৫. কোদাল, রশি।
৬. কাগজ, কলম ইত্যাদি।
কাজের ধাপ
১. সবজি চাষের জন্য চাষ করা জমি নিতে হবে বা জমি চাষ করে প্রস্তুত করতে হবে।
২. যে সবজি চাষ করা হবে সে সবজির জন্য নির্ধারিত মাপ দিয়ে জমি চিহ্নিত করে খুটি পুঁতে দিতে হবে। প্রয়োজনে সুতলি টেনে লাইন সমান করে নিতে হবে।
৩. সবজি এক সারি, দুই সারি, তিন সারি বা চার সারি পদ্ধতিতে রোপণ/বপন করা হলে সেভাবে জমিতে নকশা করতে হবে।
৪. নির্দিষ্ট দূরত্ব পরে পরে ২৫-৩০ সেমি, চওড়া ও ১৫২০ সেমি. গভীর করে নালা কেটে পাশে মাটি উঠায়ে
৫. নালার মাটি উঠায়ে দিয়ে বেড তৈরি করে তা সমতল ও পরিপাটি করতে হবে, যাতে লাইন টেনে, মাদা তৈরি দিতে হবে। এতে বেড জমি সমতল হতে কিছুটা উঁচু হবে। নালা সেচ, নিকাশ ও চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হবে। বা গত তৈরি করে বীজ/চারা রোপণ/বপণ করা যায়।
প্রাথমিক তথ্য- ফসলের জমিতে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হয়। যেমন নালা যা ভূপৃষ্ঠ ও ভূনিম্নস্থ হতে পারে। পানির উৎস্য হতে (ডিপ বা স্যালো পাম্পের সাহায্যে, এলএলপির সাহায্যে বা কোন উঁচু জলাধার হতে) বিভিন্ন ধরনের নালা তৈরি করে জমিতে সেচ দেয়া হয়। জমি হতে অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়ার জন্য নালা ব্যবহার করা হয়। এ নালা ২ ধরনের হয়। যথা- প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম। আবার কার্যপদ্ধতি অনুসারে নিকাশ নালা ৩ ধরনের হয়। যথা ভূপৃষ্ঠ নিষ্কাশন নালা, ভূনিম্নস্থ নালা ও সম্বিলিত ভূপৃষ্ঠ ও ভূনিম্নস্থ নালা ।
প্রয়োজনীয় উপকরণ
১। মাপ ফিতা, ২ । কোদাল, ৩। রশি, ৪। কাঠি, ৫। খুটি, ৬। ঝুড়ি, ৭। শ্রমিক, ৮। কাগজ, কলম, পেন্সিল, ইরেজার, ১০। সেচ বা নিকাশের জন্য নালার ডিজাইন লে-আউট।
কাজের ধাপ
১. সেচ নালা বা নিকাশ নালার ডিজাইন বুঝে নিয়ে মাঠে লেআউট দিতে (খুটি পুঁতে রশি টেনে) হবে।
২. নালা কাটার আগেই মাটির ধরন, পানি প্রবাহের উৎস ও পরিমাণ এবং জমির অবস্থান বুঝে নিতে হবে।
৩. সেচ পদ্ধতি নির্ধরণ করে নালা তৈরি করতে হবে। যেমন- মুক্ত পাবন পদ্ধতি, নিয়ন্ত্রিত পাবন পদ্ধতি, ফারো বা খাদ সেচ পদ্ধতি, বেসিন ও রিং বেসিন পদ্ধতি।
৪. মুক্ত প্লাবন পদ্ধতিতে সেচের জন্য যে জমিতে সেচ দেয়া হবে সে জমির আইল শক্ত করতে হবে এবং নালা দিয়ে পানি প্রবাহিত করে সম্পূর্ণ জমি একপ্রান্ত হতে প্লাবিত হতে হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যাবে।
৫. নিয়ন্ত্রিত প্লাবন পদ্ধতি সমতল জমিতে প্রয়োগ করা হয়। এতে জমির প্রত্যেকটি খন্ড আইল দ্বারা পৃথকীকরণ থাকে এবং প্রতি আইল পর মাঠ নালার সাথে যুক্ত থাকে। সেখান দিয়ে জমিতে পানি প্রবেশ করানো হয়। জমি খণ্ডগুলো ৩-১৫ মিটার এবং লম্বা ৬০-৩০০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে ।
৬. সারিতে বা আইল করে বীজ বা চারা রোপণ করা সবজির জমিতে অগভীর খাদ বা নালা তৈরি করা হয়। সকল নালার একদিক দিয়ে সরবরাহ লাইন নালা তৈরি করা হয়। সরবরাহ নালা দিয়ে পানি প্রবাহিত করলে সকল খাদ বা অগভীর নালায় পানি প্রবেশ করে।
৭. কাষ্ঠল সবজির বাগানে রিং পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হয়। গাছের চারিদিকের মাটি বৃত্তাকার করে হালকা নিচু করা হয় এবং বাহির দিক উঁচু আইলের মত করে দেয়া হয়। প্রতি ২ সারি পর পর সরবরাহ নালা করা হয়। এ নালার সাথে গাছের বৃত্তাকারের সংযোগ করে দেয়া হয়। প্রধান নালা দিয়ে পানি প্রবাহিত করা হলে প্রতি গাছের গোড়ার বৃত্তাকারে পানি চলে যায়।
৮. সবজির বেডের ফাঁকে, আইলের ফাঁকে বা মাদার কাছে পানি বদ্ধতা হলে সবজি জাতীয় ফসল ২-৪ ঘন্টা সহ্য করতে পারে। সবজি ক্ষেতে পানি বন্ধ হলে পানি তলের গভীরতা নিচে নামানোর জন্য প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক নিকাশ ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। অর্থাৎ পানি বের হওয়ার প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। সরবরাহ নালার পানি উপরে উঠে আসলে জমির আইল শক্ত করে কৃত্রিমভাবে নিকাশ করতে হবে। অর্থাৎ পাম্প ব্যবহার করতে হবে।
প্রাথমিক তথ্য
মাটির প্রকার, ভৌত রাসায়নিক অবস্থা, আবহাওয়া, সারের প্রকার ও পরিমাণ, ফসলের প্রকার ও শেকড়ের প্রকৃতি, খাদ্য পরিশাষেণ ক্ষমতা ইত্যাদি ভেদে সার প্রয়োগ বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। তবে সার প্রয়োগ যখন জমি তৈরির শেষ সময়ে করা হয় তাকে মৌল বা প্রাথমিক প্রয়োগ ধরা হয় এবং পরবর্তীতে যতবারই দেয়া হয় তাকে উপরি প্রয়োগ ধরা হয়। প্রাথমিক প্রয়োগ করা সারগুলোকে ফসলের শেকড়ের নাগালের মধ্যে দেয়া দরকার এবং ধীরে ধীরে দ্রবণের জন্য আগাম প্রয়োগ করে ফসলের প্রয়োজনের সময় পরিশাষেণ উপযোগী করা। এর ফলে সারের রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রভাবে বীজ/চারা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে না।
প্রাথমিক সার প্রয়োগ বিভিন্ন পদ্ধতিতে হতে পারে। যেমনঃ
(ক) ছিটিয়ে প্রয়োগ,
খ) স্থানীয় প্রয়োগ
১। চারার গর্তে
২। মাদায় প্রয়োগ
৩। লাঙ্গল স্তরে প্রয়োগ
৪। বীজ বপন যন্ত্রের সাহায্যে প্রয়োগ ও
৫। সিরিঞ্জের ন্যায় প্রবিষ্ঠকরণ পদ্ধতি।
প্রয়োজনীয় উপকরণ-
১। সার, ২। আগার/নিড়ানী/খতা/কোদাল, ৩। সাবল, ৪। লাংগল, ৫। মই, ৬। বীজ বপন যন্ত্র, ৭। সার প্রবিষ্ঠকরণ যন্ত্র, ৮। সার, ৯। খাতা কলম ইত্যাদি।
কাজের ধাপ
১. জমি চাষের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ শেষ চাষের পূর্বে জমিতে মই দেওয়ার আগে ধীরে ধীরে পরিশাষেণ উপযোগী হয়। এ সমস্ত সারগুলোকে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হয়। যেমন ফসফরাস, এমওপি, জিপসাম, জৈব সার, চুন, ডিএপি, জিংক ইত্যাদি। এসমত সার প্রয়োগ করাকে মৌল/প্রাথমিক প্রয়োগ বলা হয় ।
২. প্রাথমিক/মৌল সার প্রয়োগের পর আড়াআড়িভাবে মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। স্বল্প মেয়াদি ও ঘন করে ছিটিয়ে যে সমস্ত শাক-সবজি বপন করা হয় সেক্ষেত্রে এ পদ্ধতি বেশি প্রযাজ্যে।
৩. অনুর্বর জমি হলে ফসলের শিকড়ের কাছাকাছি সার দেয়ার জন্য মৌল সারের ৫০% চারা বা বীজের কাছাকাছি। দিতে হবে। যেমন: ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটোর চারা রোপণের গর্তে মিশিয়ে দিতে হবে।
৪. লাউ, শশা, কুমড়া জাতীয় গাছের মাদায় বীজ রোপণের পূর্বে মাটির সাথে ৫০% মৌল সার মিশিয়ে দিতে হবে।
৫. ধনে, মূলা, সিলারী, গিমা কলমির বীজ বপনের পূর্বে লাংগল দিয়ে অগভীর নালা করে সেখান দিয়ে সার ছিটিয়ে। হালকা মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এর উপর দিয়ে বীজ বুনে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
৬. বীজ বপন যন্ত্রে বীজের সাথে পাশাপাশি বাক্সে সার দিতে হয়।
৭. বীজ বপন যন্ত্র টেনে নিলে বীজ বপনের পাশাপাশি সারও আতে আতে ফারায়োর বা নালার মধ্যে পড়বে। এর পিছনে মই টেনে বা পা দিয়ে মাটি টেনে দিলে বীজ ঢেকে যাবে। এতে বীজের কাছাকাছি সার থাকবে এবং বীজ গজানোর পর শেকড় ছাড়ার সাথে সাথে সার হতে পুষ্টি উপাদান পরিশাষেণ করতে পারবে।
৮. সিরিঞ্জ বা প্রবিষ্ঠকরণ যন্ত্রের ভিতর সার ভর্তি করা হয়। রোপিত অথচ কিছুটা বড় গাছ/চারার গোড়া হতে ৭/৮ সেমি. হতে ১০/১৫ সেমি. দূরে সিরিঞ্জের ফলা/মাথা মাটিতে প্রবেশ করানো হয়। এরপর উপরের হাতলে চাপ দিলে নির্দিষ্ট পরিমাণ সার মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সার প্রবেশ করানারে পর ছিদ্রের মুখ বন্ধ করে দিতে হয়।